বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০২০

নীল প্রজাপতি

#নীল_প্রজাপতি 
প্রেতাত্মার লেখা গল্প - Written by A R Shipon 


নীলাভ মোমবাতির আলো,
নীল আকাশের নিচে,
নীল অর্কিডের উপর বসে,
নীল রঙের পাখা দু'টি নাড়িয়ে,
মনে দোল জাগায় নীল প্রজাপতি।
নীল শাড়ি অঙ্গে তার,
নীল জলে উড়াউড়ি,
নীল ভ্রমরের সাথে করে ঘোরাঘুরি,
ছুঁয়ে'দে এ মন নীল রঙে সারাক্ষন।
নীল পুঞ্জাক্ষির দৃষ্টিতে,
নীল বেদনা সঙ্গে নিয়ে,
নীল পাহাড়ে যাবো হারিয়ে,
ভালবাসার রঙ মেখে,
যাবো নীল প্রজাপতিকে অর্ধাঙ্গিনী করে, নীল জোছনার আলোয় ভেসে।

নীল প্রজাপতি তার ছোট পাখনায় ভর করে উড়ে উড়ে চলছে। ক্লান্ত সে, অবিস্রান্ত সে। মাঝখানে গাছের পাতায় বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেওয়া। তারপর আবার উড়ে চলা পাখনামেলে। উড়তে উড়তে ছোট এক অট্টালিকার জানালায় গিয়ে বসে। খোলা জানালা।


সারাদিন ব্যাস্ত অফিস শেষে ক্লান্ত শরীরে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসে দুপুর । সদ্য  গ্রাজুয়েশন শেষ করে ১টা ছোট মাল্টিন্যাশনাল ফার্মে চাকরি করছে । 
বাসার সামনে এসে দরজার লক খুলতে গিয়ে দেখে দরজাটা ভিতর থেকে লাগানো । দুপুর কিছুটা অবাক হয়। অবাক হয়া রই কথা । দুপুর ফ্ল্যাটে একা থাকে , চাবিও সুধু তার কাছেই । তাহলে ভেতরে কে??
কিছু সময় ভেবেচিন্তে চাপ দেয় কলিংবেলে । তার কিছুক্ষন পর দরজা খুলে দেয় ভেতর থেকে একজন ।

ঘরের ভেতরের জন কে দেখে দুপুরের আরো বেশি অবাক হওয়ার কথা ছিলো , কিন্তু সে অবাক না হয়ে মুগ্ধ হলো । সত্যিই সামনে যে দাড়িয়ে আছে তাকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় আছে? যেন স্বর্গ থেকে হুরপরী নেমে এসেছে নীল শাড়ি পরে । নীল শাড়ি , নীল চুরি্‌, কালো ব্লাউজ , কালো টিপ , চোখে আবছা কাজল , সব মিলিয়ে আগুনের নীলাভ সৌন্দর্যের  চেয়েও কয়েকগুন বেশি সুন্দরী লাগছে রোদেলাকে । 
রোদেলা কে?  প্রশ্ন জাগছে কি মনে??? 
রোদেলা দুপুরের প্রেমিকা । দীর্ঘ ৪ বছর ধরে প্রেম করছে ওরা , দুপুর যখন গ্রাম থেকে এসে ঢাকা ভর্তি হয় তখন থেকে ওদের সম্পর্কের শুরু । এরকম পবিত্র প্রেম এখন আর সচরাচর দেখা যায় না। গভীর এই ভালোবাসা, গভীর এ বন্ধন।

রোদেলা ঃ কি স্যার , আপনি কি ঘরে আসবেন না ? নাকি সারারাত বাইরেই দাড়িয়ে থাকবেন ?

দুপুরঃ আমার দুচোখ কি বলছে জানো ?

রোদেলা ঃ হ্যা । খুব ভালো করে জানি । সে বলছে আমি আজ ক্লান্তিহীন , আজ আমি এই পেত্নীটাকে দেখবো দুচোখ ভরে । ঠিক তো ????

কথা টা বলে দুজনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরা অবস্থা। রোদেলা দুপুরের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায় ।

রোদেলা দুপুরের গলা থেকে টাই খুলে দিয়ে টায়েল হাতে দিয়ে বলে ফ্রেশ হয়ে আসতে । দুপুর তাই করে । ফ্রেশ হয়ে রুমে গিয়ে প্রতিদিনের মত সিগারেট ধরিয়ে সুখ টান দেয়। 

রোদেলা ঃ দুপুর, এই বিশ্রী গন্ধ আসছে কোথায় থেকে ( বলতে বলতে বেডরুমে ঢুকে) ।

দুপুর সিগারেট পেছনে লুকায়, কিন্তু রোদেলা ততক্ষনে দেখে ফেলেছে । মেয়েটার চোখে পানি চলে এসেছে ।

রোদেলা ঃ তুমি আমার কাছে প্রমিজ করেছিলে যে তুমি আর স্মোক করবে না ।

দুপুর রোদেলার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কপালে ১টা চুমু খেয়ে বলে,

দুপুর ঃ আজ তোমাকে , মানে পেত্নীটাকে ছুয়ে প্রেতাত্মা প্রমিজ করছে যে প্রেতাত্মা আর কোনোদিন সিগারেট খাবে না । কিন্তু পেত্নীটাকেও কথা দিতে হবে যে সে প্রেতাত্মাকে কোনদিন ছেড়ে যাবে না । কি প্রমিজ করো ? (হাত বাড়িয়ে দেয় দুপুর)

রোদেলা ঃ (দুপুরের বুকে মাথা রেখে আর এক হাত দুপুরের হাতে রেখে) মনে আছে দুপুর ? আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম যে আমি একদিন তোমার বউ হবো , তোমার সংসার করবো । বউ হয়ে এসে আমি তোমার সংসার করছি। আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি । তুমিও তোমার কথা রাখবে , আমাকে দেওয়া কোন প্রমিজ ভাংবে না কিন্তু। (রোদেলার চোখে পানি)

দুপুর ঃ জি মহারানী । মহারানী আমার যে এখন খুব খুদা লেগেছে , কিছু কি খাবারের ব্যবস্থা করেছেন এই অধম রাজার জন্য?

রোদেলা ঃ জী অধম মহারাজ আপনার জন্য ব্যাবস্থা হয়েছে , আপনি আসুন । আমি টেবিলে সব সাজাচ্ছি ।

রোদেলা টেবিলে সব গুছিয়ে দুপুর কে ডাক  দেয় , দুপুর আসে । টেবিলে দুপুর বসার পর রোদেলা লাইট বন্ধ করে মোম জালিয়ে দেয় ।

দুপুর ঃ ক্যান্ডেললাইট ডিনারের ব্যাবস্থা ? বাহ দারুন তো ।

রোদেলা ঃ আমি আমার প্রেতাত্মাকে আজ নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াবো ।

দুপুর ঃ একি । আমার সব পছন্দের খাবারই তো দেখি তুমি রান্না করেছে । চিংড়ীর মালাইকারী , ইলিশের পাতুরী । গরুর মাংশের কালোভুনা । জান তুমি এতো কিছু কখন করলে ?

রোদেলা ঃ খাওয়ার সময় বেশি কথা বলতে হয় না । চুপ করে খাও । ( বলে রোদেলা হাত পাখা দিয়ে দুপুরকে বাতাস করা শুরু করে)

দুপুর ঃ রোদেলা , বাতি না জললেও ফ্যান কিন্তু চলছে ।

রোদেলা ঃ আমি জানি ।

দুপুর ঃ তাহলে বাতাস করছো যে ?

রোদেলা ঃ স্বামী খাওয়ার সময় তাকে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে হয়। তুমি কি সেটাও জানো না ?

কথা টা শুনে দুপুর হেসে কুটিকুটি হয়ে যায় ।

খাওয়ার পর্ব শেষ করে দুপুর বেডরুমে গিয়ে সুয়ে পরে । রোদেলা একবাটি পায়েশ নিয়ে এসে দুপুর কে খেতে বলে কিন্তু দুপুর বলে যে সে আজ অনেক খেয়েছে, তাই সে আর খেতে পারবে না ।

তারপর দুপুর আর রোদেলা সুয়ে পরে , গল্প করতে থাকে দুজনে। বলতে গেলে সারারাত গল্প করে কাটয়ে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পরে দুজন একজন আরেকজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

ভোর ৬টার মত বাজে । দুপুরের ফোনে মাহাদির কল আসে । প্রথমবার টের পায় না , পরেরবার ঘুম ভেঙ্গে যায় দুপুরের । ফোন টা পিক করে দুপুর,

দুপুর ঃ কিরে দোস্ত ? এতো সকালে ?

মাহাদী ঃ দোস্ত তুই কোথায় রে ?

দুপুর ঃ এই তো বাসায় ঘুমাচ্ছিলাম । কেন মামা ?

মাহাদি ঃ দোস্ত ১টা ব্যাড নিউজ আছে । রোদেলা গতকাল সন্ধ্যায় রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে । আমি মাত্রই খবরটা পেলাম । তাই তোকে জানালাম ।

দুপুর ঃ ধুর গাধা । রোদেলা আমার বাসায় , আমার সাথেই আছে ।(কথাটা বলে পাসে ফিরে দেখে রোদেলা নেই , সেখানে ১টা চিঠি পরে আছে ) আমি তোকে একটু পর ফোন দিচ্ছি(নিচু কন্ঠে)।

চিঠিটা হাতে নিয়ে খুলে পড়া শুরু করে দুপুর

আমার জীবনের সবচাইতে দামী আর প্রিয় মানুষ আমার প্রেতাত্মা, আমার ভালোবাসা, রোদেলার দুপুর। 

আমাদের জীবন টা খুবই নাটকীয়। হাজার রঙ্গে আচ্ছন্য । আর যে এই নাটক টা পরিচালনা করছে সেও কেমন জানি । এই দেখো সোনাবাবু , আমাকে তোমার কাছ থেকে নিয়ে চলে গেলো । হ্যা আমি আর বেচে নেই । 
এই, তুমি কিন্তু একদমই কাদবে না। 
জানো যখন এক্সিডেন্ট টা হয় , খুব রক্ত ঝরছিলো , ব্যাথাও হচ্ছিলো অনেক । একটা সময় বুঝতে পারি যে আমি আর বেশিক্ষন নেই এই পৃথিবীতে , জানো তখন আরো বেশি খারাপ লাগছিল এই ভেবে যে আমি চলে গেলে তুমি খুব একা হয়ে যাবে । কে দেখেশুনে রাখবে পেত্নীর এই প্রেতাত্মাটা কে । কিন্তু একটা সময় আমাকে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে হয় । কিন্তু তোমাকে তো কথা দিয়েছিলাম যে আমি একদিন আমি তোমার নীল বউ হবো ঐ নীল প্রজাতির মত,  প্রেতাত্মা আর পেত্নীর ছোট একটা গোছানো সংসার হবে, তোমার সব পছন্দের খাবার আমি রান্না করে খাওয়াবো। বাবু, আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি, যদিও স্বার্থপরের মত আবার তোমাকে একা রেখে চলেও আসতে হল। কিন্তু সেটাতে তো আর আমার হাত নেই, সেই গাড়ির ড্রাইভার আমাকে তোমার কাছ থেকে চিরতরে দূরে সড়িয়ে দিল। শুনো টুকিপুকিটা, তুমিও কিন্তু আমাকে দেওয়া তোমার প্রতিটা কথাগুলো রাখবে । কোন বাজে কাজ করবে না । আর আমার কথা মনে করে উল্টো পাল্টা  কিছু করবে না । তবে চিঠিটা পড়ার পর খুব করে কাদবে , তাহলে মন টা হালকা হবে । আর প্লিজ নামাজ পরে আমার জন্য দোয়া করবে । আমার লাশ দেখতে যাবে, শেষবারের মত তোমায় দেখার অপেক্ষায় থাকবো। আর জীবন টা কে নতুন করে সাজাবে । নিজের খেয়াল রাখবে । আর মনে রাখবে “””” পেত্নীর ভালোবাসা কিন্তু প্রেতাত্তার কাছেই গচ্ছিত থাকবে “”””

আল্লাহ হাফেজ ।

চিঠিটা পরে কান্নায় ভেঙ্গে পরে দুপুর । খুব করে কান্না করে। আর সেই ক্লান্ত, অনিস্রান্ত নীল প্রজাপতিটা দুপুরের চারপাশ ঘিরে উড়ে বেড়ায়।  কিছু একটা বলতে চায়, বারবার ছুয়ে যেতে চায় দুপরকে সেই নীল প্রজাপতিটা। 


(পুরো গল্পটিই আমার কল্পনা, বাস্তবতার সাথে এর কোন ধরনের মিল নেই)