শুক্রবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৩

মেঘদূত

‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ আকাশে নূতন মেঘ! মেঘের কী অপূর্ব সাজ আর বাহারী আওয়াজ। প্রিয়া দরশনে কাতর বিরহী জনের মনোহভিলাষ বাষ্পীভূত হয়ে ঘণীভূত হয়েছে মেঘদলে। মেঘের মায়াময় গম্ভীর সঘন গর্জন যেনো বিরহীর সুতীব্র অনুভব অনুনাদ। অন্তরের গভীর প্রদেশে প্রিয়া অভিলাষে মনোবেদনার ক্রন্দনধ্বনি মেঘনাদে ধারিত। মেঘের এই গুরুগম্ভীর নিনাদে বিরহ চৈতন্যের আবেগ সঞ্চারিত করে অচেতন মেঘকে বিরহের তীব্রতায় সচেতন করে বার্তাবাহক দূত হিসেবে প্রিয়ার কাছে প্রেরণ করেছেন মহাকবি কালিদাস। এ-এক অপূর্ব বিরহ-বেদনা মথিত গীতিকাব্য। প্রিয়জন থেকে সুদূরে অবস্থানরত প্রিয়জনের একান্ত সান্নিধ্য বঞ্চিত জীবনের আবেগময় কাতর অনুভব মেঘকে তথা প্রকৃতিকে আশ্রয় করে অনন্য-অনবদ্য ভঙ্গীমায় মেঘদূতে এমনভাবে প্রকাশিত যাতে প্রস্ফুটিত হয়েছে প্রকৃতির সাথে জীবনের এক নিখুঁত সমীকরণ। কর্তব্যে অবহেলার জন্য এক প্রেমিক যক্ষ অভিশপ্ত হয়ে এক বছরের জন্য পত্নী বিরহিত জীবন যাপন করতে রামগিরি আশ্রমে নির্বাসিত হয়। স্থানটি স্নিগ্ধছায়াতরুময় এবং তথাকার জল সীতার স্নানহেতু অতিশয় পবিত্র। শুরু হলো যক্ষের নির্বাসিত জীবন। কয়েকমাস গত হলো। বিরহ-যাতনায় শীর্ণ যক্ষের কনকবলয় বাহুস্খলিত হওয়ায় কান্তাবিরহে অধীর যক্ষ রিক্ত হয়। এসময়েই আষাঢ়ের প্রথম দিবসে শৈলনিতম্বের আলিঙ্গনাবদ্ধ গজের ন্যায় একখণ্ড মেঘ সন্দর্শনে বিরহ-কাতর নতদেহ যক্ষের চিত্ত দূরবর্তী প্রিয়া দর্শনে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। হৃদয়ের সমস্ত অশ্রু বাষ্পীভূত করে অর্ঘ্য সাজিয়ে মেঘকেই সে তার সুবল সখা জ্ঞান করে প্রীতিপূর্ণ বাক্যে তার কুশল জিজ্ঞাসা করে। আশ্চর্য হতে হয় এই ভেবে ধুম, জ্যোতি, জল ও বায়ুর সমষ্টি সৃষ্ট অচেতন এই মেঘদল কী করে ইন্দ্রিয় সমর্থ হয়ে বিরহীর কাতর অনুভব পৌঁছে দেবে তার প্রিয়ার কাছে? কীভাবে সংবেদন দ্যোতনা তৈরী হবে এই জড় সমষ্টিতে? কীরূপেই বা মেঘখণ্ড হয়ে উঠবে বার্তাবাহক মেঘদূত? এখানেই মহাকবি কালিদাসের সার্থকতা। কল্পনায় মেঘখণ্ডকে ইন্দ্রিয়ানুভব প্রদান করে মেঘের স্তুতি করে যক্ষ বলছে, “ওগো মেঘ, আমি জানি তুমি পুষ্কর এবং আবর্তক মেঘের বংশে জন্মগ্রহণ করেছ, তুমি ইন্দ্রের প্রধান সহচর, তুমি তোমার ইচ্ছানুযায়ী রূপগ্রহণ করতে পারো! অদৃষ্টবশে আমার প্রিয়া আজ দূরবর্তী, তাই তোমার কাছে আমি প্রার্থী হয়ে এসেছি; গুণবান ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা যদি ব্যর্থ হয় তবে তাও ভালো- অধম ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা সফল হলেও তা বরণীয় হতে পারে না।” প্রিয়া সান্নিধ্য বঞ্চিত হৃদয়ের আর্তি কোনো বাধ মানে না। আর মানে না বলেই কামার্ত দেহমনন চেতন-অচেতন ভেদজ্ঞান ঊর্ধ্বে নিক্ষিপ্ত হয়ে বলে, “বায়ুপথে তোমাকে উড়ে যেতে দেখলে প্রোষিতভর্তৃকা নারীদের মনে আশার সঞ্চার হবে, এইবার বুঝি মিলনকাল আসন্ন- তারা এলোচুলের প্রান্তভাগ তুলে নিয়ে তোমাকে দেখবে। আমার মতো পরাধীন ব্যক্তি ছাড়া আর কে আছে যে তোমার উদয়ে তার বিরহ-ব্যাকুল প্রিয়াকে উপেক্ষা করবে?” বিরহীর উদ্বেলিত মনন মেঘদলকে প্রলুব্ধ করছে এই বলে যে, তার উড়ে যাওয়ার গতিপথে প্রোষিতভর্তৃকা রমণীগণ এলোচুলের প্রান্তভাগ তুলে মেঘখণ্ডের উড়ে যাওয়া দেখবে আর ভাববে এইবার বুঝি মিলনকাল আসন্ন। মেঘকে উদ্দেশ করে বিরহীর এরূপ আর্তি অচৈতন্যিক বাষ্পপুঞ্জকে বাস্তবত চৈতন্যিক রূপ না দিলেও এ দৃশ্যকল্প অসাধারণ নয়নমনোহর হয়ে মননে ভাবরসের অপূর্ব ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। বর্ষাকালে বিরহিণীর প্রাণধারণ কঠিন। অতএব, আসন্ন শ্রাবণে অশেষ প্রীতিসহকারে প্রণয়বচনযুক্ত স্বাগত সম্ভাষণে মেঘের উদ্দেশে কবির নিবেদন, “ওগো সুন্দর! তোমার বিরহে সিন্ধু নদ শুকিয়ে হয়েছে একখানি বেণীর মতো। তার জলের ধারা অত্যন্ত সূক্ষ্ম। দুই তীরের তরু থেকে জীর্ণ পাতা খসে পড়েছে বলেই তার জলের ধারা পাণ্ডুবর্ণ। বিরহদশায় তোমার অতীত সৌভাগ্যের কথাই সে যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে। এই নদী যাতে কৃশতা ত্যাগ করতে পারে তার ব্যবস্থা তুমিই করো। তুমি বর্ষণ করলেই সে কূলপ্লাবী হয়ে উঠবে।” এভাবেই পথ বাতলে দিয়ে পথে যেতে যেতে বিভিন্ন করণীয় নির্দেশ করে মেঘকে উদ্দেশ করে যক্ষ বলছে, “পথ তোমার জন্য মোটেই ক্লান্তিকর হবে না। যাত্রাপথে পাবে জল, পাবে ছায়া। দেখবে মধুর দৃশ্য, শুনবে কিন্নরীদের গান। আর শুধু যদি একটু মন্দ্রধ্বনি করো তবে মৃদঙ্গের শিবসঙ্গীতে সঙ্গত হবে। সজলনয়নে ময়ূরেরা কেকাধ্বনিতে স্বাগত জানাবে তোমায়। শুধু তাই নয় তোমার যে গর্জনে ভূমি ভেদ করে ভূকন্দলী ফুল বেরিয়ে এসে ঘোষণা করে- এইবার পৃথিবী শস্যশালিনী তথা অবন্ধ্যা হবে, তোমার সেই শ্রবণ মধুর গর্জনে মানসযাত্রী রাজহংসের দল মুখে মৃণালখণ্ড বহন করে কৈলাস পর্যন্ত তোমার সঙ্গী হবে। আর বিভিন্ন বর্ণের রত্ন একসঙ্গে মেশালে যেমন সুন্দর দেখায় তেমনি সুন্দর ইন্দ্রধনু পর্বতের উপর স্থিত বল্মীকের স্তূপ থেকে ধীরে ধীরে উঠবে। তুমি যখন উত্তর দিকে যাত্রা করবে তখন তোমার দেহলগ্ন হবে সেই ইন্দ্রধনু। তখন তোমার দেহে কত শোভা বাড়বে বলো তো! কৃষ্ণ যেমন সুন্দর ময়ূরপুচ্ছ তার মোহনচূড়ায় সাজিয়ে গোপাল বেশে সাজতেন তোমার সজ্জাও হবে ঠিক তেমনি। এভাবেই পথবিহারে এক আনন্দময় যাত্রা শেষে তুমি কৈলাসে এসে পড়বে। আর কৈলাসের কোলেই তো অলকা। কুবেরের গৃহের উত্তরেই একটা মন্দারতরুর সামনেই আমার গৃহ। তথায় অবস্থান করছে আমার প্রাণাধিক প্রিয়া, যুবতীসৃষ্টিতে তিনিই বিধাতার প্রথম নির্মিতি।” কল্পনাশক্তির কী অপূর্ব বিস্তার! বিস্তারিত হয়ে তা ক্রমেই তুলে আনছে ভূমণ্ডল, তরুলতা, লোকালয়ের পুরনারী, শস্যগন্ধা মাঠ, বিস্তৃত তৃণভূমি আর সেইসাথে যুক্ত হচ্ছে প্রিয়ার প্রতি তার বেদনা-মথিত অনুভব। যতবার মেঘদূত পড়েছি ততবারই এটিকে চলচ্চিত্র মনে হয়েছে। হৃদয়ের অনুপম অনুভবের যে গতিশীলতা এ কাব্যে দৃশ্যমান তাতে এটি মোটেই কোনো স্থিরচিত্র নয়; আকাশে উড়তে থাকা মেঘে আবেগ সঞ্চারিত করে নিজ হৃদয়ের মানচিত্র পরমাকাঙ্ক্ষিত প্রিয়জনের নিকট প্রেরণ করে দূতকে পথ নির্দেশ করতে গিয়ে কবি যেনো প্রাচীন ভারতবর্ষের ভৌগোলিক মানচিত্রটাকেই তুলি দিয়ে এঁকেছেন মেঘদূতে। “মেঘদূত” নিয়ে চলচ্চিত্র না হয়ে থাকলে এই অমর গীতিকাব্যের চলচ্চিত্রায়ন জরুরী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thank you for your participation .