শুক্রবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২১

টাইমবুক (১)

 


#টাইমবুক
(রহস্যময় কল্পবিজ্ঞান রূপগল্প)
পর্ব - ১ (এক)
সৃষ্টিতে ঃ প্রেতাত্মার লেখা গল্প - Written by A R Shipon

চোখের সামনে আমার বইয়ের সমুদ্র ;
এক রাত, দু’রাত, হাজারো রাত কাটে বিনিদ্র এলোমেলো,
বই খুলে এই যে আমার বসে থাকা,
অনিশ্চিত ভবিষ্যত পানে ধীরে পায়ে এগিয়ে যাওয়া ।
সাদা পাতা খাতার কালো মেঘে পূর্ণ ।
তলে তলে লিখে যাই ; করে যাই হিমালয় চূর্ণ ।

পেছন থেকে হাত তালির শব্দ। পরক্ষনেই নূপুর এর ছন্দ, কেউ একজন এগিয়ে আসছে আমারই দিকে।

প্রায় তিনবছর আগের কথা, আমি এভাবেই ছাদে বসে থাকতাম। নাহ এভাবে না, ছাদের এক কোনে যেখানে সবচাইতে গাড় অন্ধকার থাকতো। তখন ছাদের কার্নিশ ঘেষে বসার মত সাহস ছিলো না, তবে এখন কারের মতই তখনো বিষন্ন ছিলাম। সেই বিষন্নতা কাটাতে নীল শাড়ীতে রোদেলা আসতো। সারাদিনের যতকথা, যত আক্ষেপ আর ভালবাসা তা পূর্ন করে দিয়ে চলে যেত। এখন আর কেউ আসে না। এখন আমার সাহস বেরেছে, এখন ছাদের কার্নিশে পা ঝুলিয়ে বসে থাকি। সিগারেট টানি, মাঝে মাঝে অন্য কিছুও থাকে। শুধু থাকে না পাশে বসে কেউ গল্প শোনানোর। এখন তো আগের থেকেও অনেক বেশি বিষন্ন, কিন্তু নুপুরের ছন্দ মাতিয়ে রোদেলা এখন আর আসে না। নূপুরের ছন্দ বলতেই মনে পরলো আমরা তো ছিলাম অন্যখানে। আচ্ছা কে আসছে....?

পেছনে নূপুরের শব্দ কানে ভাঁসছে, কেউ একজন আসছে আমি জানি। তবে সে আর যেই হোক রোদেলা না। কারন আমি নিজেই হত্যা করেছি রোদেলা। সে চাইলেও আর কোনদিন এখানে আসতে পারবে না। তাহলে পেছনে কে আসছে, কেউ তো নেই যে আমাকে ভালোবাসে। তাহলে কি কেউ আমাকে খুন করতে আসছে কেউ? ছাদের কার্নিস থেকে আস্তা ধাক্কা দিলেই ৭ তালা থেকে পড়ে থেতলে যাব। পোস্ট মর্টাম করলে ধরা পরবে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছাদ থেকে পড়ে গেছে অথবা আত্তহত্যা। কতই সহজ তাই না আমাকে মেরা ফেলা?  হ্যা, আমাকে রৌদসী মেরেই ফেলেছে মনটাকে। এবার আসুক কেউ ছাঁদ থেকে ফেলে আমাকে খুন করে এই বিষন্ন ছলনাময়ী স্মৃতি থেকে মুক্তি দিক। আমি মুক্তির জন্য চোখ বন্ধ করলাম। নিজেকে জেনো সপে দিলাম শিকারির হাতে
♦ বাহ! কবিতাটা কিন্তু চমৎকার হয়েছে। কোথায়, আমাকে নিয়ে তো লেখোনি কোনদিন কবিতা।

আমি কিছুটা চমকে গেলাম। পেছনের মানষটির কন্ঠ রোদেলার নয়। তবে খুব পরিচিত, ভালোলাগা, মধুর একটি কন্ঠ। কিন্তু সে কেনো এখানে আসবে। যে ছলনা করে আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে দূর সমুদ্র মাঝে আমায় নিয়ে রাজপ্রাসাদ গড়বে। অতঃপর আমায় নিয়ে সমুদ্রের মাঝপথে এসে ফেলে গেছে শাকিলের হাত ধরে সে কেনো আসবে। নাহ, আমি ভুল শুনেছি।

♦ না, তুমি ভুল শোননি। আমিই এসেছি। আমার ভয় লাগছে, আমিও তোমার মত এখানে তোমার পাশে দু পা নিচে দুলিয়ে বসবো। প্লিজ উঠাও না আমাকে।
আমি পেছনে তাকাই, খুব পরিচিত মুখ। দুধে আলতা গায়ের রঙে লাল শাড়ি, চোখে কাজল, হাতে লাল চুড়ি, খোলা চুল  আর হৃদবধ করা গাড়ো পারফিউম।
হ্যা, ভুল দেখছি না। রৌদূসী এসেছে।
রৌদূসী নিজেই চেষ্টা করে উঠে আমার পাশে বসে। আমি চুপ করে বসে আছি। কোন কথা নেই, শুনশান নিরবতা এর মাঝে জোনাক পোকার ডাকের শব্দ।
রৌদূসীঃ শাকিল, কি বিচ্ছিরি লাগছে না জোনাক পোকার শব্দ। কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে আমার। প্লিজ ওদের থামাও তো একটু।
মনে মনে ভীষন রেগে গেলাম। আমার কাছে এসে সে তার ভালবাসার মানুষের নাম নিচ্ছে। তাও আবার আমাকেই সেই নামে ঢাকছে। এই মেয়েটা বুঝি আমাকে কষ্ট দিতে খুব ভালোবাসে।
রৌদূসী ঃ কথা বলছো না কেনো? প্লিজ!
আমি ঃ আপনি ভুল মানুশকে প্রশ্ন করেছেন। উত্তর আশা করেন কিভাবে?
রৌদূসীঃ মানে?
আমিঃ আমি দূপুর, শাকিল নই।
রৌদূসীঃ সরি, সরি। এই যে কান ধরছি।
রৌদূসী কান ধরে সরি বলে। তারপরেও আমি চুপ। খুব অভিমান জমেছে হৃদয়ে। কূপ থেকে তুলে এনে মাঝ সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে। ভালবাসার নামে মিথ্যে ছলনা, অভিনয় করে আমার হৃদয়াত্তাকে হত্যা করেছে। তার সাথে কিসের কথা। কেনই বা সে আমার কাছে আসে।
রৌদূসীঃ আমি জানি তুমি অভিমান করে আছো। ভালবাসার নামে দীর্ঘ সময় তোমার সাথে টাইমপাস করে আমি আমার ভালবাসার মানুষকে পেয়ে তোমায় নির্দ্ধিধায় ছেড়ে দিয়েছি। একবারও পেছন ফিরে তাঁকায় নি। আমি জানি এটা অন্যায়। কিন্তু তুমি তো বোঝ ভালবাসার মানুষকে না পাওয়ার কষ্ট। আমি আমার ভালবাসার মানুষকে পেয়ে হাড়াতে চাইনি, তাই চলে গিয়েছি। বিশ্বাস করো আমার আর কিছুই করার ছিলো না।
আমিঃ আমি তোমার কাছে কৈফিয়ত চাই নি। এখানে এসেছো কেনো? তোমার ভালবাসা কি তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে?
কথাগুলো বলার সময় আমার দারুন একটা ভাললাগা কাজ করছিলো। এইবুঝি আমার রৌদূসী ফিরে এসেছে। কিন্তু ভুল ভাঙলো পরক্ষনেই। রৌদূসী উত্তরে বললো'
নাহ সে আমায় ছেড়ে যায়নি৷ আমরা দুজন ভালোই আছি। শাকিল আমার অনেক কেয়ার করে, সময় দেয়।'
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আসলে সে আমার হবার নয়। আমার কপালটাই এমন, ভালোবাসা এই ছোট ভাঙাচোরা কপালে নেই। আমি আবার রৌদূসীকে প্রশ্ন করলাম
আমিঃ তাহলে আমার কাছে আবার এসেছো কেনো?
রৌদূসীঃ তুমিই তো সারাক্ষন ডাকো। এতো ডাক, এতো ভালোবাসা আমি অগ্রাহ্য করতে আর পারছি না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি এখন থেকে প্রতিদিন তোমার কাছে আসবো। তোমার জীবনটা গুছিয়ে দিয়ে তারপরেই যাবো।
একদম
হাহাহাহাহাহাহাহা করে উন্মাদের মত হাঁসতে হাঁসতে আমি পেছনে পরে যাই। একটু হলেই সামনের দিকে পরে যেতাম। আর সামনে পরলেই হয়তো মৃত্যু, যার অপরনাম মুক্তি।
পেছনে পরলেও খুব একটা ব্যাথা পাইনি। আমার নিচেই ছিলো বই এর স্তুপ। আমি আসে পাসে তাকিয়ে দেখি রৌদূসী নেই৷ ভয়ে বোধহয় পালিয়ে গেছে।
আমি যে বইএর স্তুপের নিচে বসে আছে সেটা এই বাড়ির চিলোকোঠায় থাকা এক বৃদ্ধের বই। তিনি সপ্তাখানেক আগে মারা গেছেন করোনাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন ভদ্রলোক। অবসরের পরে গৃহসংসার ত্যাগ করে এই বাড়ির চিলেকোঠায় উঠেছিলেন। বাড়িওয়ালার কাছে শুনেছি। উনি নাকি ছোট খাটো একজন বিজ্ঞানীও বটে। তিনি মারা যাবার পর ঐ চিলেকোঠা আমি ভাড়া নিয়েছি। ঘরের ভেতরের সব আসবাবপত্র  বাড়ীওয়ালা নিয়ে গেলেও ভদ্রলোকের বেড এবং সব বই আমি রেখে দিয়েছি বাড়ীওয়ালাকে অনেক অনুনয় বিনয়ের পরে৷ সেই বই গুলোই এইখানে।
আবার নূপুরের ছন্দ। রৌদূসী আবার আসছে। সামনে এসে হাটু গেড়ে বসে বইগুলো নাড়াচাড়া করছে। রৌদূসী বই খুব একটা পড়ে বলে আমার মনে হয় না। তবে অভিনয় ভালো জানে তো তাই কোন মূহুর্তে কি করতে হবে সেটা সে ভালোই জানে।
রৌদূসীঃ এই সব বই তো টাইম মেশিন নিয়ে মনে হচ্ছে। ব্যাটায় কি টাইমমেশিন বানাতে চাচ্ছিলো নাকি? বিজ্ঞানিও নাকি ছিলো সে।
আমিঃ সে বিজ্ঞানী ছিলো এই কথা কে বলেছে তোমাকে?
রৌদূসীঃ কে আবার, তুমিই তো বলছিলে মনে মনে।
আমিঃ আজিব। আমি মনে মনে বললে তুমি শুনবে কিভাবে? আমি তো আর চিৎকার করে বলিনি।
রৌদূসীঃ আমি তোমার মনের সব কথা জানি, তোমার মনের সবটুকু বুঝি।
আমিঃ সত্যিই যদি এতো মন বুঝো তাহলে এইটুকু বোঝ না যে এই মন তোমাকে কতটা ভালবাসে?
রৌদূসী চুপ করে আছে। নিচের দিকে মন কালো করে একটার পর একটা বই উল্টিয়ে পাল্টিয়ে নাম গুলো দেখছে। তারপর আমার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে উত্তর দেয় " আমি শাকিলকে ভালবাসি, ভিষন ভালোবাসি।"
আমার তখন প্রতুত্তরে বলতে ইচ্ছে করছিলো তাহলে কোন অপরাধে আমার সাথে তিনবছরের বেশি সময় ধরে ভালবাসার নাটক করে আমাকে এইভাবে মেরে চলে গেলে। কিন্তু আমি বলিনি। আমি আমার ভালবাসার মানুষকে অপরাধী করতে চাই না। খুব ভালোবাসি যে আমি তাকে। সে শাকিলকে যতটা ভালবাসে তার থেকেও লক্ষ কোটি গুন বেশি ভালবাসি আমি তাকে।
আমি বইগুলো একটার উপর একটা রেখে গুছিয়ে সবগুলো বই চিলেকোঠার রুমে নেই। আজ প্রথমদিন এই চিলেকোঠায়, এবং আজই প্রথম রাত হবে এখানে আমার।
রুমের লাইট ফ্যানের সুইচ সব কিছুই অন্যরকম। উল্টো করে লাগানো। এর মাঝে একটা সুইচ আছে যেটা কালো রঙের সুইচ। সেই সুইচটার মধ্যেই আলো জ্বলবার কথা কিন্তু জ্বলছে না। মেজাজটা এইগুলা দেখে একটু খারাপ। খেয়াল করি চারদেয়ালে একটা বক্সের মত। বুঝলাম না বিষয়টি কি।
এতো না ভেবে কোন রকম হাত মুখ ধুয়ে এসে বিছানায় সুয়ে পরি। রাত একটার একটু বেশি হয়েছে বোধহয়। আজ এখানে প্রথম রাত, ঘুম এমনিতেও হবে না জানি, যদিও ১০ টা ঘুমের ট্যাবলেট ইতিমধ্যে পাকস্থলীতে ফেলে দিয়েছি।
বিছানার একপাশ থেকে আরেকপাশ হচ্ছি। কিন্তু ঘুম আসছে না। ঘুম আসবে কিভাবে, চোখ বন্ধ করলেই রৌদূসীর সাথে সে সুখময় দিনগুলোর স্মৃতি কল্পনায় ভেসে উঠে। আর ঘুম হয় না। এমনটা প্রায় প্রতিদিনই হয়। তারপর ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুম দিতে হয়। তবে ইদানীং ঘুমের ঔষধও কাজ করছে না। এভাবে চললে হয়তো আর বড়জোড় ৫/৬ মাস সুস্থ থাকবো, তারপর কি হবে জানিনা।
এপাশ ওপাশ করতে করতে রাত দুইটা বেজে গেলো। মোবাইলে সময়টা দেখলাম। মোবাইল রাখার সময় আমার চোখ পরলো সুইচবোর্ডে৷ সেই কাল সুইচটাতে সবজ আলো জ্বলছে। আমি উঠে গিয়ে সুইচটা চাপলাম। আচমকা পুরো রুমটা গাড় অন্ধকার হয়ে গেলো। মোবাইল নিয়ে উঠি নাই। কোন রকম অন্ধের মত আন্দাজ করে বেডে গিয়ে সুয়ে পরি। বালিসের পাসে হাতাহাতি করেও মোবাইলটা খুজে পেলাম না। তবে খেয়াল করলাম বিছানাটা খুব আরামদায়ক লাগছে। চারিদিকে সকল ধরনের শব্দ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে মৃদ একটা মধুর বাজনা বাঝছে একদম নিন্মস্বরে। আমি দুই হাত আর দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে সুয়ে পরলাম। অদ্ভুত মিষ্টি একটা সাউন্ড, বৃষ্টি, ঝর্নার শব্দ, সমুদ্রের ঢেউ, পাখির ডাক, ঝড়াপাতার শব্দ। অসম্ভব মিষ্টি শব্দ। আমি এর আগে অনেকবার ইউটিউবে রিল্যাক্সিং স্লিপিং মিউজিক শুনেছি। কিন্তু এই শব্দ শুনিনি। আমার চোখ ঘুম ধরছে। আমি কল্পনা করছি। আবার মনে হচ্ছে আমি আলফা জিরোতে পৌছে যাচ্ছি। আমি কল্পনায় রৌদূসীর হাত ধরে অনেক উঁচু কোন জায়গায় গাছের ফাকা দিয়ে ঝড়াপাতার উপর দিয়ে রৌদূসীকে নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি ঝর্নার দিকে। তারপর সব অন্ধকার। আমি গাড়ো ঘুমে ঢলে পরলাম।
চলবে........
পরবর্তী পর্ব আগামীকাল দেওয়া হবে। যাদের গল্পটি ভালো লেগেছে তার অবশ্যই লাইক, কমেন্টস, শেয়ার ও আমাকে ফলো করবেন পরবর্তী পর্ব পেতে। অগ্রিম ধন্যবাদ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thank you for your participation .