শনিবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২৪

অক্টোলাইট

#অক্টোলাইট সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে আসার সময় অনূপ এমন কিছু আজগুবি জিনিস এনেছিলো যা দেখলে স্বাভাবিক ভোজনরসিকদের গা গোলাবে৷ এই যেমন কাঁকড়া, স্টু করা শামুক আর অক্টোপাস৷ তাও সেগুলো নাকি খাওয়ার জন্য৷ হৃদর তো বলেই বসলো যে ও গরু, খাসি বা মুরগী আর ছুঁয়েও দেখবে না৷ দোকানের কন্টাক্ট নাম্বার অণুপ ম্যানেজ করেছে৷ চাইলে ওরা কুরিয়ারে পার্সেল করবে নানারকম মাছের শুটকি আর অক্টোপাস৷ আমি একবার চেষ্টা করেছিলাম এই আট পেয়ে জন্তুটাকে খেয়ে দেখার৷ একটা কর্ষিকায় কামড় বসাতেই যখন মনে হলো যে জীবটা তখনো ঠিক যেন মরেনি, মুখের ভেতর নড়ে উঠেছে আমি টেবিলেই বমন কার্যটা সেরেছিলাম। কয়েকদিন স্বপ্নেও দেখেছি এই বিদঘুটে প্রানীটাকে আমার খাবার হিসেবে পরিবেশন করা হচ্ছে৷ একদম জোরজবরদস্তি করে হাত পা বেঁধে খাওয়ানোর চেষ্টা৷ অথচ হৃদয়, অনূপ,জয় কি অনায়াসে বলে দিলো যে এরপর থেকে অন্য কোন মাংস খাবেই না। আসলে খাদ্যাভ্যাস ব্যাপারটাই কেমন যেন গোলমেলে৷ আমার স্কুল বন্ধু নাজমুলকে তার বাবা বাড়ি থেকে প্রায় বের করে দিয়েছিলো রাস্তায় মরে থাকা সাপ ভাজি করে খাওয়ার জন্য৷ ও উল্টো প্রতিবাদ করে বলেছিলো ” নিজে মাইরা তো খাইনাই, মরা জিনিস খাইতে সমস্যা কি? ” পরে ওর কাছে শুনেছিলাম শোল মাছের মতন স্বাদ নাকি সেই সাপের৷ কি অদ্ভুত রুচি নাজমুলের৷ যাই হোক। কদিন পর হৃদয়ের সাথে ভার্সিটিতে দেখা৷ ওর চেহারায় একটা পরিবর্তন এসেছে৷ ধরতে কিছুটা সময় লাগলো৷ পরে বুঝলাম ও মুটিয়ে গিয়েছে। মুখের চামড়ায় হালকা লালচে ছোপ। ঠোঁটের কোণায় একটু ফেটে গেছে মনে হলো। তবুও চোখেমুখে একটা চাকচিক্য চোখে পড়ছে৷ যেন কোন ব্যাপার নিয়ে অনেক বেশি উত্তেজিত৷ জিজ্ঞেস করায় বললো ” জানিনা রে, তবে আজকাল জীবনটা অনেক সুন্দর মনে হয়। আর যখনি এটা মনে হয় তখন মনে হয় হয়তো আর বেশিদিন বাঁচবো না৷ আনন্দ আর বিষাদের একটা মিশ্র অনুভূতি৷ বাদ দে।” আমি একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম৷ বেচারা সমুদ্র দর্শন সেরে এসে দার্শনিক হয়ে গেলো নাকি? নাকি অক্টোপাস খেয়ে এই অবস্থা৷ হতেও তো পারে অক্টোপাস সমুদ্রের সেরা দার্শনিক প্রানীদের মধ্যে একটা? হা!হা!হা! ভাবতেই গম্ভীরমুখে উদাস ভঙ্গিতে বসে থাকা একটা অক্টোপাসের কথা মনে এলো। কি উদ্ভট! কি হাস্যকর! হৃদয়কে বললাম ” তোর একমাত্র প্রোটিনের উৎসের কি খবর? ” অন্যমনষ্ক থাকায় ও প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝে বললো “সে তো ভালোই৷ আজও একটা পার্সেল এসেছে৷ এবার একটু বেশি আনিয়েছি৷ ওরা জানিয়েছে কয়েকদিন সমুদ্রে বিপদ সংকেত চলবে। অক্টোপাস যারা ধরে তারা কাজে যাবে না৷ তাই আপাতত সার্ভিস বন্ধ থাকবে৷ তাই বেশি করে অর্ডার করে ফেললাম৷ ” “ আচ্ছা, তুই কি সত্যি সত্যিই অন্য সব মাংস খাওয়া ছেড়ে দিলি? মানে বুঝলাম যে ঐ কিম্ভুতকিমাকার প্রাণীটার মাংস তোর ভালো লাগে। তাই বলে ছোটবেলা থেকে যে খাবারগুলো খেয়ে বড় হয়েছিস সেগুলো একেবারে বাদ! “ “ না ঠিক একেবারে বাদ নয় । মাঝেমধ্যে খাবো । তবে এক অক্টোপাসের যতগুলো জাত আছে সেগুলোই সারাজীবনে খেয়ে শেষ করা যাবে না।“ বললো হৃদয়। “দেখ! আমি এই আটপেয়ে জন্তুটা সম্পর্কে তেমন জানিনা কিন্তু এদের মধ্যে কিছু নাকি খুব বিষাক্ত আর ভয়ানক হয় ? বললাম আমি। “কিন্তু বন্ধু, কথায় আছে বিষে বিষক্ষয়। বিশেষ জাতগুলো ছাড়াও সাধারণ অক্টোপাসে কিছু বিষাক্ত উপাদান থেকে যায়। সেগুলো হজম করে করে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। চিন্তার কিছু নেই।“ আমি আর কথা বাড়ালাম না। ওর যা ভালো মনে হয় করুক। বড়লোকদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটু আধটু পাগলামী মানিয়ে যায়। ওরা মধ্যবিত্তের মতন স্বাভাবিক হলেই কেমন যেন খটকা লাগে । মনে হয় অভিনয় করছে। তার ওপর ওর তথাকথিত প্রেমিকা তৃষা ওকে ছেড়ে আরেক ধনীর দুলালের সাথে দিন কাটাচ্ছে। সব ভুলে ও কিছু একটা নিয়ে ব্যাস্ত থাকুক। সেন্টমার্টিন ট্যুরটাও ওর মন ভালো করে দেয়ার জন্যই করা। যদিও ওর কাছে মরিশাস বা পাতায়া বীচ ঘুরে আসাটাও ডালভাত। মামা আমেরিকার সিটিজেন। কিন্তু বন্ধুদের সাথে নাকি জাহান্নামেও ভালো লাগে ওর। ক্লাস সেরে টিউশন শেষ করে মেসে ফিরলাম রাতে। এসে দেখি মিলের অবস্থা ভয়াবহ । বাইন মাছের ঝোল। খালাকে এতবার বলেও এই জঘন্য খাবারটা দেয়া থেকে বিরত রাখতে পারিনি। তরকারী দেখেই খাবার ইচ্ছাটা চলে গেছে। অক্টোপাসের কথা মনে পড়ে গেছে । চোখের ভুলে বাইন মাছের কিলবিলে দেহটাও যেন দেখলাম। এই ধরনের পরিস্থিতিতে এলাকার সবচেয়ে নিম্নমানের হোটেলটাও বন্ধ থাকবে, এটাই নিয়ম। তাই আর নিচে নামলাম না। রুমে কফি আছে। খেয়ে ঘুম দেবো। আজকাল ক্যাফেইন আমার শরীরে উল্টো প্রভাব ফেলছে। ঘুম তাড়ানোর বদলে বাড়াচ্ছে। কফি খেয়ে শার্লক হোমসের “দ্যা লায়ন্স মেন” গল্পটা পড়তে পড়তে কখন যে টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। ঘুম ভাঙলো এক অদ্ভুত শিহরণে । যেন কোন অক্টোপাস তার আটটা কর্ষিকার সবগুলো দিয়ে আমায় আগাগোড়া পেঁচিয়ে ধরেছে। আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। খুব কম সময়ের অনুভূতি কিন্তু দারুণ জীবন্ত। পরে খেয়াল হলো আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। দেখলাম হৃদয়ের সাথে একটা রেস্টুরেন্টে বসে সী ফুড খাচ্ছি আমি। সমুদ্রতীরে বালির ওপর স্থাপিত এই রেস্টুরেন্টে বসেই মনটা ভালো হয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়াচ্ছে। আমার প্লেটে একটা কমলা রঙের কাঁকড়া। হৃদয়ের প্লেটে সেই অক্টোপাস। নানা বিষয় নিয়ে কথা বলার একফাঁকে হৃদয় হুট করে বলে উঠলো “ভুলেও আশেপাশের টেবিলের দিকে তাকাবি না শিপন। চুপচাপ খেয়ে চল উঠে পড়ি।“ মানব মন সবসময় আকস্মিক কৌতুহলে গা ভাসায়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো । এক ঝটকায় চারপাশের টেবিলে মনোযোগ দিলাম আর পরক্ষণেই মনে হলো হৃদয়ের কথাই শোনা উচিৎ ছিলো আমার। একমাত্র আমাদের টেবিল ছাড়া বাকি প্রত্যেকটা টেবিলে বসে আছে প্রায় মানুষের সমান আকৃতির অক্টোপাস। তাদের সামনেও খাবারের প্লেট আর সেই খাবারের নমুনা দেখেই আমার রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেলো। কারো পাতে মানুষের হাত কারো পাতে মাথা , কেউ মনুষ্য হৃদপিণ্ড চিবিয়ে খাচ্ছে। সবই তাদের সামনের দিকে কর্ষিকা দুটো দিয়ে। বাকি ছয়টি কর্ষিকা বিশ্রীভাবে কিলবিল করছে । অনেকটা “ পাইরেটস অব দ্যা ক্যারিবিয়ান ” মুভির ডেভি জোনসের মুখের মতন অবস্থা। আমাকে তাকাতে নিষেধ করার কারণটা একটু পর আরো ভালোভাবে বুঝলাম । অক্টোপাসের দল প্রথম নির্লিপ্ত অবস্থায় খাবারে মনোযোগ দিলেও আমি তাকানোতে যেন তাদের মধ্যে একটা বিরক্তির উদ্রেক হলো । আর ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগলো তাদের ছয়টি কর্ষিকার সঞ্চালনা। সেগুলো আন্দোলিত হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট ছন্দে। মূহুর্তে চারপাশ ছেয়ে গেলো একটা কিচকিচ শব্দে। প্রথমে শব্দের মাত্রা মৃদু ছিলো কিন্তু ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকলো । কানে তালা লেগে যাবার উপক্রম হলো । যেন কান ফেটে রক্ত বের হবে। চিনচিনে একটা ব্যাথা অনুভব করলাম মাথায়। মাথায় হাত রাখতেই সর্বাঙ্গ শিউরে উঠলো! হাত স্পর্শ করছে অসংখ্য ক্লেদাক্ত শুঁড়। নাকে এলো পচা মাছের গন্ধ। এক ধরনের তরলে ভেসে যাচ্ছে মাথার কাছের শুঁড়ের জায়গাগুলো। আমি আবার তাকালাম ঐ অক্টোপাসগুলোর দিকে । ওদের চোখেমুখে আবার আগের সেই নির্লিপ্ত ভাব। সামনে দুটো কর্ষিকা দিয়ে আগের মতন ভক্ষণ করে চলেছে মানুষের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। শুধু বাকি ছয়টি কর্ষিকা ধীরে ধীরে আমায় পেঁচিয়ে গ্রাস করে নিচ্ছে। শেষবারের মতন হৃদয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও হাসিমুখে অক্টোপাসের শেষ টুকরোটি মুখে পুরলো! “ এই দুঃস্বপ্ন সারাদিন হৃদয়ের সাথে বসে অক্টোপাস নিয়ে আলোচনার ফল তাতে কোন সন্দেহ নেই । ঘেমে গেছি। তার ওপর কফি খেয়ে ঘুমানোতে ডিহাইড্রেশনে পড়ে গেছি। গলা শুঁকনো পাতার মতন খরখরে হয়ে গেছে। বোতল থেকে পানি ঢেলে খেলাম। যেন এক মরুভূমি বুকের মধ্যে পুষে রেখেছি আমি। এক দুই ঢোক পানিতে সে তৃষ্ণা মিটবে না। পুরো বোতল খালি করে সিড়ি বেঁয়ে নিছে নামলাম। চাপকল থেকে ঠান্ডা পানি নিতে হবে। দুঃস্বপ্নের প্রভাবটা এত গাঢ় যে সিড়ি দিয়ে নামার সময় মনে হলো আমার পেছনে অজস্র শুঁড় কিলবিল করতে করতে নেমে আসছে। সারারাত আর ঘুম হলো না। ঘোরলাগা একটা ভাব নিয়ে বাকি রাতটা কাটিয়ে দিলাম। কিছু স্বপ্ন কেন যে এত দাগ কাটে মনে জানিনা। ভেবেছিলাম সকালে ক্যাম্পাসে গিয়ে হৃদয়কে স্বপ্নের কথাটা বলবো কিন্তু গিয়ে দেখি ও আসেনি। ইদানীং ক্লাসে আসা কমিয়ে দিয়েছে ও। অন্যদের বললে ওরা হাসাহাসি করবে। বলবে “সামান্য একটা দুঃস্বপ্ন নিয়ে এত মাতামাতি কিসের। এসব স্বপ্নের কোন মানে হয় না। তুই ও কি হৃদয়ের মতন পাগলামি শুরু করলি? “ ক্লাস সেরে ঠিক করলাম হৃদয়ের বাসায় যাবো। ওর সাথে এ ব্যাপারে কথা না বলে কেন জানি শান্তি পাবো না। ওর বাসা কাছেই কিন্তু ঢাকার জ্যামে পড়ে পড়ন্ত বিকেল সন্ধ্যায় গিয়ে ঠেকলো। যখন ওদের দরজার কলিং বেলে চাপ দিই তখন সূর্য ডুবে গেছে। দরজা খুলে দিলো আমাদের ক্যাম্পাসের আয়া, অনূপের শিলা খালার জমাই মুকিত চাচা। শিলা খালা ভার্সিটিতে আর মুকিত চাচা হৃদয়দের বাড়িতে কাজ করে। এখানেই থাকে দুজনে। দরজা খুলতেই একটা ধাক্কা খেলাম। মুকিত চাচার চোখদুটোয় যে কিসের এক পরিবর্তন। ঠিক ধরতে পারলাম না কিন্তু কিছু একটা হয়েছে তার সেটা নিশ্চিত। বললাম “ চাচার শরীরটা ভালো তো। চোখমুখ এমন শুকিয়ে গেছে কেন? “ গরীব মানুষ , আমগো আর শইল । ভালাই আছি বাজান। উফরে যান । ছুডু বাবা গরেই আছে। “ বললো চাচা। আমি আচ্ছা বলে উপরে উঠতে যাবো তখন শীলা খালা পেছন থেকে ডেকে বললেন “ সাবধানে থাইকেন মামা । ছুডু বাবা রাইগা আছেন। “ এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি শিলা খালার মুখে। হৃদয় কি কারণে রেগে আছে সেটা ঘরে গিয়েই দেখা যাবে ভেবে আমি আর কথা বাড়ালাম না। ঘরের দরজা হাট করে খোলা। কিন্তু প্রায় অন্ধকার। শুধু টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে । হৃদয় দরজার উল্টোদিকে মুখ করে খাটের ওপর বসে আছে। আমাকে ওখান থেকে দেখার কথা না। তবু কিভাবে যেন বুঝে ফেলেছে। বললো “ শিপন ভেতরে আয়। আমি তেমন অবাক হলাম না। হয়তো মুকিত চাচার আর শিলা খালার সঙ্গে নিচে আলাপ করতে শুনেছে। “ “ কিরে রেগে আছিস নাকি? কি নিয়ে? আমি ভাবলাম তোর সাথে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার শেয়ার করবো। মৃদু হেসে বললাম আমি। হৃদয় ওদিকে ফিরেই বললো “ বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে। তাই মন খারাপ। রাগ না। তাছাড়া ব্যাবস্থা একটা করেছি। ওসব বাদ দে। তোর স্বপ্নটা বল । কি ব্যাবস্থা করেছে সেটা জানতে চাওয়ার আগেই একটা শব্দ খট করে আমায় মনের দরজায় আঘাত করলো। “ স্বপ্ন! ” আমি যে ওকে স্বপ্নের বর্ননা দেবো এটা হৃদয়ের কোনভাবেই জানার কথা নয়। কাউকে বলেছি বলেও মনে পড়ছে না। নাকি এসেই ভুলে বলে ফেলেছি। হতে পারে উত্তেজনায় পড়ে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। বললাম “ স্বপ্নে তুই একটা মোক্ষম অংশে ছিলি। একমাত্র মানব। বাকি সব তো অক্টোপাস। “ বলে আমি পুরো ঘটনাটার বর্ননা দিলাম। “ কিন্তু ওর মুখে ঠিক স্বপ্নে দেখা অক্টোপাসে মতন নির্লিপ্ততা ভর করেছে যেন। ঠোঁটের কোণায় একটা হাসির আভাস এনেও যেন ঠিক হাসলো না হৃদয়। নির্মোহ গলায় বললো “এখান থেকে চলে যা শিপন। কোন প্রশ্ন করবি না। জাস্ট চলে যা। আর শোন কখনো অক্টোপাস খাওয়ার কথা ভাববি না। বিশেষ করে যে অক্টোপাসে…” বাকি কথাটা আপনমনেই শেষ করলো সে। আমি বেশ বিরক্ত হলাম। এখনো পুরোপুরি আমার দিকে ফেরেনি। মুখের একপাশ ফেরানো। দেখে মনে হচ্ছে এড়িয়ে যেতে চাইছে। তার ওপর আবার এভাবে অভদ্রের মতন চলে যেতে বলছে । আমি ওর কাছে গিয়ে বসলাম। “কি হয়েছে তোর ? এরকম করছিস কেন? “ বলেই থমকে গেলাম। ওর চোখেও একটা পরিবর্তন । ঠিক যেরকম দেখেছিলাম মুকিত চাচার চোখে। হ্যাঁ এখন ধরতে পেরেছি। একটা কমলা রঙের আলো। জ্বলন্ত সিগারেটের আগুনের মতন দেখতে। চমকে উঠলাম কারণ প্রথমে ওটা টেবিল ল্যাম্পের প্রতিফলিত আলো মনে হলেও পরে নিশ্চিত হলাম যে ওটা হৃদয়ের চোখ ঠিকরে বের হচ্ছে । আমি চকিতে পেছনে সরে এলাম। হৃদয়ের মুখটা আগের মতই নির্লিপ্ত কিন্তু ওর দেহের চারপাশে কমলা আলোর আভা ছড়িয়ে পড়ছে। ও এখনো ঘড়ঘড়ে কন্ঠে বলে যাচ্ছে “পালিয়ে যা শিপন!” যেন ওর ভেতর থেকে কোন অশুভ শক্তি ওর গলা ঠেসে ধরেছে। এরপর আর ওর কন্ঠ শুনতে পেলাম না আমি। শুরু হলো অস্বাভাবিক মাত্রার কিচিকিচ শব্দ। যেমনটা স্বপ্নে শুনেছিলাম। আর মাথায় চিনচিনে ব্যাথাটা বুঝিয়ে দিলো হৃদয় কেন আমায় পালাতে বলছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি হৃদয়ের দেহের তলা থেকে বেরিয়ে আসছে অসংখ্য ক্লেদাক্ত শুঁড়। সেগুলো আমায় ঘিরে ফেলছে। আমি প্রাণপণে ছুট লাগালাম। সিড়ি দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে নেমে দেখি হৃদয়ের বাবা বসে আছেন ড্রয়িং রুমে। আমি কোনোমতে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম আঙ্কেল, হৃদয়…” কথা শেষ হলো না। উনি বললেন “ও তোমায় ছেড়ে দিয়েছে? কি বোকা ছেলে রে বাবা । এরকম সুস্বাদু খাবার কেউ ছাড়ে। “ বলেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমার ওপর । চোখের নিমেষে দেখলাম তিনি শুঁড়ওয়ালা এক জন্তুতে পরিণত হচ্ছেন । আমি মেঝে তে পড়ে গেলাম। তারপর হামাগুড়ি দিতে লাগলাম দরজার দিকে। আংকেলের বিবর্তিত রুপটা আমার সাথে সাথে ধ্বস্তাধস্তি করে পেরে ওঠেনি। কিন্তু দরজার কাছে গিয়েই থেমে যেতে হলো! এ বাড়িটা যে অভিশপ্ত হয়ে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই প্রভাব যে গ্রামের আলাভোলা ভালো মানুষগুলোর ওপর পড়বে তা ভাবিনি। মুকিত চাচা আর শিলা খালা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। হৃদয় আর আংকেলের বর্তমান অবস্থার সাথে তার কোন অমিল নেই। মনে পরলো অনূপের কথা, ঐ এসব এনেছিলো সেন্টমার্টিন থেকে আর হৃদয়কেও ও খায়িয়েছিলো। যার পরিণতি এই............ আমি আর এগোতে পারলাম না । স্তব্ধ অবস্থায় পড়ে গেলাম মেঝেতে। চোখ বন্ধ হবার আগে দেখলাম থকথকে একটা তরল নিঃসৃত হয়ে আমার চোখ প্রায় অন্ধ করে দিচ্ছে। যেন এসিড ঢেলে দেওয়া হয়েছে আমার চোখে। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। সেই তরলের উৎস অসংখ্য কিলবিলে শুঁড়! যখন জ্ঞান হলো আমি তখন পুরোপুরি অন্ধ। আমাকে নাকি ক্যাম্পাসে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো। আমি কিভাবে সেখানে পৌছালাম কেউ বলতে পারবে না। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে আমি কি ঘটেছে সেটা কাউকে বলিনি। কারণ সবাই ভাববে চোখ হারানোর শোকে আমি আবোল তাবোল বলছি। অণুপ, জয়, নাজমুল, নীরা, পরী ওরা সবাই দেখা করতে এসেছিলো । আমি হৃদয়ের কথা বলায় বলেছিলো ওদের কোন খোঁজখবর নেই। বাড়ি তালাবন্ধ। এরকম কিছু হবে আন্দাজ করেছিলাম। বাবা মা আমাকে চোখের চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় হৃদয়ের বড় মামা ওখানে নিয়ে এসেছেন । মামা ফিলাডেলফিয়ার এক বড় আই ইন্সটিটিউটের সাথে যোগাযোগ আছে । উইলসমোর আই ইন্সটিটিউট। এখানকার যা খরচ তা আমাদের মতন পরিবারের পক্ষে বহন করা প্রায় অসম্ভব ছিলো কিন্তু হৃদয়ের মামা কিভাবে যেন ম্যানেজ করলেন। হাসপাতালের বেডের আশেপাশে কোথাও টিভি আছে। আমার কাছে সেটা এখন রেডিওর সমান। সারাক্ষন নিউজ ফ্ল্যাশ চলে ওটাতে। বিরক্ত লাগে। শুধু একদিনের একটা নিউজ আমায় পাথর করে দিলো । সেটা শোকে না আনন্দে জানিনা। সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাসটা গাঢ় হলো। ভারত মহাসাগরে লাইট এমিটিং অক্টোপাসের খোঁজ চলছিলো । অর্থাৎ যেসব অক্টোপাসের শরীর থেকে অন্ধকারে চলাচলের জন্য আলো বিচ্ছুরিত হয়। একদল গবেষক চারটি বিশেষ অক্টোপাস খুঁজে পেয়েছেন যেগুলোর সাথে অদ্ভুতভাবে মানুষের বৈশিষ্ট্যের মিল আছে। এই নিয়ে তোলপাড় চলছে। যারা অক্টোপাস খান তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলা হচ্ছে তারা যেন এই বিশেষ প্রজাতির অক্টোপাসটি না খান। কারণ আলোক বিচ্ছুরণকারী এই অক্টোপাসের শরীরে এক বিশেষ ধরণের ইলেক্ট্রোলাইট রয়েছে। যা মানুষের দেহে প্রবেশ করলে মানবীয় আচরণের পরিবর্তন আসতে পারে। মানুষ হয়ে উঠতে পারে চরম হিংস্র। আর এই ইলেক্ট্রোলাইটের যার নাম দেয়া হয়েছে “অক্টোলাইট!“ খুব শীগগীর ঐ চারটে অক্টোপাসকে গবেষণাগারে পাঠানো হবে। দেখা হবে অক্টোলাইট আর ঠিক কি কি করতে পারে। আর এই পুরো হাসপাতালে আমি শিপনই শুধু এর উত্তর জানি!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thank you for your participation .