রবিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

ভালোবাসা

ভালোবাসা 
লেখা ঃ 

MD Asadur Rahman - Shipon
আজ এক অন্যরকম মাহাদির কথা বলব । সে আমাদের মাহাদি যার অভাবটাই এরকম। একা একা থাকা। বর্তমানে এটা আরও বেড়েছে। মাহাদির সারা দিন কাটে ছাদে বসে আকাশ দেখে দেখে। সবাই তাই ভাবে। আসলে তা না। মাহাদির দিন কাটে একজন মহান লেখকের সাথে কথা বলে। মহান সেই লেখকের নাম হুমায়ন আহমেদ! তার সাথে প্রথম দেখা হয় যেদিন মায়াবতির সাথে বিচ্ছেদ ঘটে। সেদিন মর্মাহত মাহাদি ছাদে বসে কাঁদছিল। হটাত লেখক এসে হাজির!

-এই ছেলে, কাঁদছ

কেন? মাথা তুলে তাকিয়ে মাহাদি তো অবাক!

হুমাওন আহমেদ দাঁড়িয়ে আছেন! কি আজব! মাহাদি জানে ইনি কে, তাও জিজ্ঞেস করলো,

-আপনি কে?

-আমি হিমু!

দুঃখের মাঝেও মাহাদি হা হা করে হেসে উঠল। হুমায়ন স্যার বললেন,

-তোমার চোখে পানি আর তুমি জোরে জোরে হাসছ!

-কি অদ্ভুত! মাহাদি হাসতে হাসতে বলল।

-হু। অদ্ভুতই। তুমি কি জান মানুষই একমাত্র প্রাণী, যে একসাথে হাসতে পারে, কাঁদতেও পারে!

-জানতাম না।

-না জানাই ভাল। যারা কম জানে তাদের জীবনেই ঝামেলা কম। আফসোস বয়সকালে বুঝলাম না।

-হা হা হা হা! মাহাদি আবার হেসে উঠল।

-হাসছ কেন ছেলে?

-আপনি এমন ভাবে কথা বলছেন যেন আপনি আসল হিমু । হুমায়ন আহমেদের হিমু ।

-আমি তো আসলেই হুমায়ন আহমেদের হিমু ।

-না। আপনি আমার অবচেতন মনের কল্পনা। আজ আমি বড় ধরনের কষ্ট পেয়েছি তাই আমার মস্তিক আপনাকে তৈরি করে আমার সামনে এনে দাড় করিয়েছে। সব আমার হেলুসিনেশন।

-ও!

-ও বলছেন কেন! আপনার কি ধারনা আপনি আসল হুমায়ন স্যার ?

-আমার কোন ধারনা নেই।

-ধারনা না থাকাই ভাল। আমি এখনই আপনাকে দূর করছি।

-কিভাবে ? হুমায়ন স্যার এর প্রশ্ন ! চোখে বিস্ময় !

মাহাদি বলল আমি চোখ বন্ধ করে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গুনব, তারপর চোখ খুলে দেখব আপনি নেই।

-সত্যি এতে কাজ হবে? হুমায়ন স্যার প্রশ্ন।

-একশ এক বার কাজ হবে ! কাজ না হলে আপনাকে থাপড়ায়ে বিদায় করব।

-তুমি এভাবে কথা বলছ কেন! তুমি জান না আমি কে ? সম্মান দিয়ে কথা বল !

-আপনি হুমায়ন স্যার কি না সেটা না , বিষয় হল আপনি আমার কল্পনা। আর হুমায়ন স্যারের হিমু হলেও আমার কিছু করার নেই, আপনাকে নিয়ে অনেক সংগঠন, ক্লাব আছে, ওদের কাছে জান। আপনাকে মাথায় তুলে নাচবে।

-নাচানাচি বিষয়টা মন্দ না। কিন্তু মাথায় না তুললে হয় না ? আমার ওজন একটু বেশি।

-আপনি রসিকতা করছেন !

-রসিকতা করি নি তো ! ভোগলামি করেছি!

-ভোগলামি ?!

-ভোগলামি হল ফাজলামির বড়ভাই, আপন না, দূরসম্পর্কের বড় ভাই, হা হা হা হা !!

-আপনি আমার উদ্ভট কল্পনা।

-আমি হুমায়ন আহমেদ।

মাহাদির মেজাজ চরমে উঠল। সে চিৎকার করে উঠল ‘আল্লাহ্র দোহাই, আপনি যান’। মাহাদি আর কিছু বলল না। বলতে পারল না । কিছু বলার মত অবস্থা তার ছিল না । হাঁটুতে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো ।

সেদিন সকালটা ছিল মাহাদির জন্য অশুভ । শুধু অশুভ না, মহা অশুভ। সকালে উঠেই পায়ে হোঁচট খেলো, নখও ভাঙল। কিন্তু সকালের চকচকে আকাশ দেখে মনটাই ভালো হয়ে গিয়েছিল । তাড়াহুড়ো করে পার্কে ছুটে গেল মায়াবতির সাথে দেখা করতে। মায়াবতি মাহাদির প্রেমিকা। এত তাড়াহুড়োর পরও সময় মতো যেতে পারল না। গিয়ে দেখল পার্কের বেঞ্চে মাহাবতি বসে আছে। মাহাদি পাশে গিয়ে বসে বলল,

-সরি দেরি হয়ে গেল।

-ইটস ওকে! দূরে সরে বস, এত কাছে আসছ কেন! বিরক্ত স্বরে মাহাবতি বলল।

মাহাদি অবাক হল না। মায়াবতি এমনই। জেদি আর রহস্যময়। কখন কি করে আর কি বলে ঠিক নাই। নিচ্ছুপ তাকিয়ে রইল।

-এমন করে তাকিয়ে আছ কেন? জীবনে আমাকে দেখো নাই ? মন দিয়ে শোন, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। মা তোমার সাথে আমার বিয়ে দিবে না।

-ও আচ্ছা।

-আমার বিয়ে ঠিক হচ্ছে। ছেলে আমেরিকা থাকে। বিইয়ে করে বিদেশে নিয়ে যাবে।

-ভালো তো।

-অবশ্যই ভালো। ওকে না বিয়ে করে তোমাকে করব নাকি! বিয়ে করে তোমার টিনের বাড়িতে গিয়ে উঠবো?

মাহাদি জবাব দিল না। মায়াবতি হাসতে হাসতে বলল,

-ছেলের নাম ও সুন্দর। তোমার মতো উদ্ভট টাইপের নাম না।

-ও

-দুঃখ পেয়েছ ? কান্না করতে চাইলে কান্না করতে পার। চোখে তো পানি এসে গেসে মনে হচ্ছে।

- না আসে নাই।

মায়াবতির দিকে তাকাল মাহাদি। মায়াবতি কালো শাড়ি পরে এসেছে, কি যে সুন্দর লাগছে !

-মায়াবতি তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। পরির মতো।

-আর তোমাকে লাগছে চোরের মতো। এভাবে চুল না আঁচড়ে থাকবে না।

-আচ্ছা।

-আমার উপর রাগ করেছ ?

-না।

-আমার দিকে তাকাও তো মাহাদি। মাহাদি তাকাল।

-রাগ করেছ ? মাহাদি মাথা নাড়ল। মায়াবতি হাসল। কোনও এক অদ্ভুত কারনে বোকা এই ছেলেটা মায়াবতিকে অন্ধভাবে ভালবাসে। মাহাদির চোখের দিকে তাকিয়ে মায়াবতির কান্না চলে আসছিল। কিন্তু তাকে আজ কাদলে চলবে না। কোনোভাবেই না। মেয়েদের কান্নার মূল্য নেই। তাদের জন্ম হাসবার জন্য। যখন ভালবাসার মানুষকে ছেড়ে অন্য পুরুষকে বিয়ে করতে হয়, তখনও তাদের হাসতে হয়। খুব কম মেয়েরই প্রকৃত ভালবাসার মানুষ থাকে, যাদের সাথে রাগ করে কান্না করা যায়।মায়াবতি নিজেকে তাদেরই একজন ভাবত। কিন্তু মায়ের কথা অমান্য করার মেয়ে সে না। আমেরিকা ফেরত সুপুত্র নিয়ে মা হাজির। এই বিয়ে ঠেকাবে, সাধ্য কার!

-সারা জীবন তো ভয় করে এসেছ আমাকে পাবে না। এখন তো তাই ঘটছে! ভালো লাগসে?

মাহাদি ছুপ করে রইল।

-শোন মাহাদি, এটাই জীবন। ভালবাসা বলে কিছু নাই। সব ঢং। তুমিও দুই দিন পর এক মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করবা। তার হাত ধরে পিকু পিকু কথা বলবা। দুনিয়াটাই এমন। বল ঠিক বলেসি না ?€

মাহাদি চুপ করেই রইল।

-আমাকে উঠতে হবে মাহাদি, খুব সম্ভবত এটাই আমাদের শেষ দেখা। ইচ্ছা থাকলেও আর দেখা হবে না।

-মায়াবতি?

-বল?

-তুমি আমাকে ভালোবাসো না ?

মায়াবতি এর উত্তর দিল না। এই প্রশ্নের উত্তর কি দেয়া সম্ভব! সম্ভব না।

মাহাদির মনে হল সে মরে গেছে। বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত কষ্ট। এ কষ্টের বর্ণনা নেই। মায়াবতি হেটে হেটে চলে যেতে লাগলো।মাহাদি মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। আকাশে তাকালে দেখতে পেত আকাশ মেঘে ঢাকা। সকালের চকচকে আকাশ এখন মেঘে ঢাকা পড়েছে। বৃষ্টি নামবে, মাহাদির প্রিয় পরিবেশ। এমনই এক দিনে মায়াবতির সাথে তার প্রেম হয়েছিল।

আবার এমন এক দিনেই সব শেষ হয়ে গেল।

প্রকৃতি সব মনে রাখে।

মানুষ ভুল করে, প্রকৃতি ভুল করে না।

মানুষ ভুলে যায়, প্রকৃতি ভুলে যায় না।

মাহাদির দিন এখন কাটে ছাদে বসে। চিন্তা ভাবনা করে। চিন্তার বিষয় একজন, মায়াবতি। মায়াবতিচেহারা ধিরে ধিরে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে মাহাদির কাছে, মাহাদি আর আগের মতো কল্পনা করতে পারেনা। সব কিছুই কেমন ঝাপসা, ঘোলাটে। অদ্ভুত এক পৃথিবীতে আটকে আছে মাহাদি। যে পৃথিবীতে মায়াবতি ছাড়া আর কার অস্তিত্ব নেই। অনেক চেষ্টা করল মাহাদি, মাইয়াবতির চেহারাটা কল্পনাতে দেখতে। কিছুতেই পারল না। এমন হয়, খুব প্রিও মানুষের চেহারাই সবার আগে মানুষ ভুলে যায়। আবার অনেক অপ্রিয় মানুষের চেহারা স্পষ্ট মনে থাকে।

ইদানিং হুমায়ন স্যার সাহেব আর জ্বালাতন করেন না। হটাত কি মনে করে তিনি উদয় হলেন।

-আপনি আবার এসেছেন ?

-না এসে উপায় কি, কাল দুবাই চলে যাবো। শেষ দেখা করতে আসলাম।

-দুবাই যাবেন কেন!

-সেখানে যাবার শখ আমার দীর্ঘদিনের। খেজুর খাব।

-খেজুর খেতে দুবাই যেতে হবে কেন ?

-ইচ্ছা হয়েছে খেজুর গাছে বসে পাগড়ি মাথায় খেজুর খাব। ভালো ইচ্ছা না ভাইজান ?

মাহাদি কোনও কথা বলল না। নিজের কল্পনার সাথে উদ্ভট আলোচনার মানে হয়না। সে নিজেই বুঝতে পারল পাগলামি বাড়ছে।

-যাবার আগে কয়েকটা কথা বলে যাই, মন দিয়ে শোন।

-বলেন।

-আজ তুমি গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু করতে যাচ্ছ, ঠিক?

-আপনি এটা জানেন কারন আপনি আমার কল্পনা। আসলে আপনি হচ্ছেন আমি আর আমি হলাম আপনি।

-সে যাই হোক। তুমি যেটা করতে যাচ্ছ সেটা কি ঠিক হবে?

-হাঁ, ঠিক হবে।

-আমার তা মনে হয়না।

-আপনার কি মনে হয় তা দিয়ে আমার কিছু আসে যায় না।

-আসে যায়, কারন আমি হলাম তুমি আর তুমি হলে আমি ! হাহাহাহাহা!

মাহাদি কোনও উত্তর দিল না।

-শোন মাহাদি, মায়াবতি ধনীর মেয়ে। তুমি কি মনে কর তোমার এই চিলেকোঠার ঘরে ও থাকতে পারত?

-না।

-আমেরিকা তে সে কি ভালো থাকবে না ?

-থাকবে।

-সে কি তোমাকে ভালবাসে না ?

-অবশ্যই বাসে!

-ও তো মরে যায়নি, তুমি কেন মরে যাবে মাহাদি? মৃত্যুর মাঝে সার্থকতা নেই, সার্থকতা বেঁচে থাকার মাঝে। যতদিন বেঁচে আছ মায়াবতিকে ভালবেসে যাও।

সার্থকতার এই অদ্ভুত ব্যাখ্যা শুনে আপন মনে হাসল মাহাদি। এ ব্যাখ্যা তার নিজের। তার অবচেতন মন নিজের অস্তিত্ব রক্ষার শেষ চেষ্টা করেছে। হিমু হয়ে দেখা দিয়েছে। হয়তবা সফল ও হয়েছে।

কি জানি কেন, মাহাদির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।

সামান্য বিদ্রুপ আর অসামান্য কষ্টের হাসি। এ বিদ্রুপ নিজের জন্য। শুধুই নিজের জন্য।

আষাঢ় মাস। আকাশ কাল মেঘে ঢেকে গেছে। বৃষ্টি নামবে। মাহাদি তবুও জোরে হাঁটছে না। নামুক বৃষ্টি, ভিজতে সমস্যা কি।

এখন মাহাদি গ্রামের এক স্কুলে মাস্টারি করে। জীবন কার জন্য থেমে থাকে না। চলতে থাকে। মাহাদিরও থেমে থাকে নাই। বিয়ে করেছে গ্রামের খুব সাধারন এক মেয়েকে।

রেনু আজও বুঝতে পারেনাই, শহরের এই লোকটা কেন তার মতো এক গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করল। সে দেখতে আহামরি কিছুনা। আর দশটা সাধারন মেয়ের মতো। নিজেকে খুব সুখি মনে হয় রেনুর। আধাপাগল লোকটাকে খুব ভালবাসে, কিন্তু কোনোদিন কিছু বলতে পারেনা। লোকটার অদ্ভুত কিছু স্বভাব আছে। রেনু যখন ঘুমিয়ে পড়ে, মাহাদি তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। রেনু ঘুমিয়ে পরার ভান করে, জেগে থাকলে কখনই এই লোকটা মমতার পরশ দিবেনা। তার মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে মানুষটার হাতটা ধরতে। কখনই ধরা হয়না। মানুষটা কি কি সব অদ্ভুত কথা বলে, তার সব রেনু বুঝে না। তবু শুনতে অনেক ভালো লাগে। বৃষ্টি হলেই মানুষটা উঠানে বসে থাকে, মাঝে মাঝে গান ও গায়। গানের গলা মোটেও ভালো না। কিন্তু সেটাও রেনুর খুব ভালো লাগে। যখন ঝুম বৃষ্টি পড়ে, মানুষটা তখন নিঃশব্দে কাঁদে। রেনুর তখন খুব কষ্ট হয়। মানুষটার মনে কি এত দুঃখ! ইচ্ছা করে চোখের পানি মুছে দিতে, কিন্তু রেনু তা কখনই পারেনা।

ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ছে। ঘন ঘন বাজ পড়ছে।মাহাদি উঠোনে বসে আছে নির্বিকার। বৃষ্টির ঝাপটা তার গায়ে লাগছে। রাতের অন্ধকার যেন বেরেই চলছে । রেনুর খুব ভয় করছিল, সে মাহাদির পাসে এসে বসলো। ‘ভয় লাগছে রেনু? কাছে এসে বস’ মাহাদি বলল। রেনু আর কাছে গিয়ে বসলো। ‘হাত টা ধর তো শক্ত করে’। রেনুর কাছে সপ্নের মতো লাগছিল। আজ সে হাত ধরবেই। কাঁপাকাঁপা হাতে মাহাদির হাত ধরল রেনু। এ ভালোবাসার স্পর্শ, যার জন্য মানুষ আকুলভাবে আসায় থাকে।

রেনুর হাত শক্ত করে ধরে রাখল মাহাদি। অবিরাম বৃষ্টি। মাহাদির দৃষ্টি আকাসে, বিজলি চমকাল। রেনুও আকাসে তাকিয়ে ছিল। মাহাদির দিকে তাকালে দেখতে পেত তার চোখে পানি।

এ কান্না নিয়তির জন্য।

আর তার ভালোবাসার মায়াবতির জন্য।

মাহাদি জানে না ঠিক এই মুহূর্তে এ গ্রাম থেকে সহস্র সহস্র মাইল দুরের এক অতি উন্নত দেশেও অবিরাম বৃষ্টি পড়ছে। সুখের সেই দেশের ছোট্ট এক এপার্টমেন্টের ছোট্ট এক জানালায় অসুখী এক মেয়ে মাহাদির জন্য কাঁদছে।

মাহাদির চোখের পানি মুছে দেবার জন্য কেউ আছে।

সেই মেয়েটির নেই।



আমার আরো গল্প পরতে চাইলে লাইক দিতে পারেন আমার পেজটি ঃhttps://www.facebook.com/arshipon15/

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thank you for your participation .